সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ড নিয়ে এর আগে নানা খবর ছাপা হয়েছে। এবার জিয়া হত্যা নিয়ে চাঞ্চল্যকর নতুন তথ্য ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ বইয়ে তুলে ধরেছেন লেখক গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ। কয়েকজন সাবেক সেনা কর্মকর্তার জবানি নিয়ে তার লেখা এই বইটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাপেইজ পাঠকদের জন্য জিয়া হত্যাকান্ডের ঘটনার প্রথম পর্ব তুলে ধরা হলো-
চট্টগ্রাম সেনানিবাসে প্রতি মাসের শেষ তিন দিন নাইট ট্রেনিং হয়। নিয়মিত এই কর্মসূচির মধ্যেই ২৯ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসেন। ওই দিনই নাইট ট্রেনিং শুরু হওয়ার কথা। ট্রেনিং চলে সন্ধ্যা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত। পরদিন সকালে সবাইকে অফিসে যেতে হয়।
সেনানিবাসে খেলাধূলার অনেক সুযোগ সুবিধা।
চট্টগ্রামে আর্মি ফুটবল, ভলিবল ও বাস্কেটবল টিমের একচ্ছত্র ক্যাপ্টেন হলেন মেজর রেজাউল করিম। সিনিয়র ও বন্ধুরা ডাকে রেজা। তিনি চৌকস খেলোয়াড়। ৩০ মে মেজর রেজার একটা ফুটবল ম্যাচ নির্ধারিত ছিল। ২৯ মে বিকেলে গ্যারিসনের খেলার মাঠে বেশ কিছুক্ষণ অনুশীলন করেন রেজা। দেখলেন প্রেসিডেন্টের এডিসি ক্যাপ্টেন মাজহার এদিকে আসছেন। রেজা তাঁকে দেখেই ডাকলেন, অ্যাই মাজহার, কী খবর?
প্রেসিডেন্ট তো সার্কিট হাউজে। একটু ফাঁক পেয়ে চলে এসেছি স্যার, বন্ধুরে সঙ্গে দেখা করতে।
গুড, গুড।
ঘণ্টাখানেক অনুশীলন করে রেজা বাসায় এলেন। চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ভেতরেই তাঁর থাকার কোয়ার্টার। মাংসের হাড় দিয়ে একটা স্যুপ বানিয়ে রেখেছেন তাঁর স্ত্রী । এক চুমুকেই সেটি খেলেন। তেমন স্বাদের নয়। নিয়মিত এটা খান তিনি । বিশেষ করে যখন খেলাধুলা থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসা থেকে আবার বের হলেন নাইট ট্রেনিংয়ের উদ্দেশ্যে।
নাইট ট্রেনিংয়ে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যেই হাজির হতে হয়। যাঁরা খেলাধুলা করেন, তাঁরা কেউ কেউ রাত আটটা-সাড়ে আটটার মধ্যে পৌছান। ঘণ্টাখানেক থেকে চলে আসেন। অন্যরা থাকেন রাত ১২টা পর্যন্ত। নাইট ফায়ারিং থাকলে বেশি রাত হয়, কখনো কখনো রাত তিনটাও বেজে যায়। পরদিন সকালে আবার হাজিরা দিতে হয় অফিসে।
নাইট ট্রেনিং থেকে ফেরার সময় ব্রিগেড মেজর সাইফুল্লাহ মোহাম্মদ খালেদকে খুঁজলেন রেজা। খালেদ যে ব্রিগেডে, তার ব্রিগেডিয়ার আহমেদ। মহসিন রেজা কমান্ডার উদ্দিন দুপুরেই খালেদকে বলে রেখেছিলেন যে তাঁর একটা বল চাই। ইবিআরসির (ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার) কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আজিজকে বলে রেখেছিলেন একটা বাস দেওয়ার জন্য। খেলোয়াড়দের আনা-নেওয়ার জন্য বড় একটা বাস দরকার। প্রেসিডেন্টের গার্ড রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন হাফিজ রেজার ব্যাচমেট। তাঁরা একসঙ্গে ভারতের তান্ডয়াতে প্রশিক্ষণ নিয়ে জাতীয় রক্ষীবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। পরে রক্ষীবাহিনী ভেঙে দিলে সবাই সেনাবাহিনীতে ঢুকে পড়েন। হাফিজের সঙ্গে রেজার বন্ধুত্ব¡ অনেক দিনের। হাফিজ গান-বাজনা করেন। বন্ধুরা তাকে ডাকেন কিশোর কুমার। রেজাকে ফোন করে হাফিজ বললেন, দোস্ত, প্রেসিডেন্ট তো কাল চলে যাবেন। আমি স্যারকে বলে ছুটি নিয়েছি। প্রেসিডেন্টকে প্লেনে উঠিয়ে দিয়ে আমি থেকে যাব। তুই অন পেমেন্টে একটা গাড়ির ব্যবস্থা রাখিস। দুই বন্ধু মিলে বিকেলে ঘুরব।
রেজা একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে রাখলেন। বল আর জোগাড় হয়নি। অফিসের কাছ দিয়েই বাসায় যেতে হয়। রাতে বাসায় ফেরার পথে রেজা দেখলেন, অফিসের বারান্দায় মেজর খালেদ অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। তাঁকে দেখেই রেজা বললেন, আমার বল কই?
আরে রাখ! এখন বল দেওয়ার টাইম নাই।
রেজা দেখলেন, খালেদ অফিস থেকে বেরিয়ে রাস্তায় একটা কালভার্টের কাছে গিয়ে কার সঙ্গে যেন ফিসফিস করে কথা বলছেন। রাত তখন ১০টা। আবছা আলোয় ঠাহর করা যায় না, ওখানে আর কে কে আছে। রেজা আর এগোলেন না। বুঝলেন যে বল পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তার চেয়ে বাসায় গিয়ে ঘুমানোই উত্তম। বিশ্রাম দরকার। কেননা, পরদিন খেলা আছে।
রেজা বাসায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। সকালে ঘুম ভাঙল দরজায় ঠকঠক শব্দ শুনে। কেউ একজন ডাকছে বাইরে থেকে, স্যার, স্যার!
দরজা খুলে রেজা দেখলেন তাঁর পিয়ন। মাথায় হেলমেট, কাঁদে রাইফেল। পিঠে রাকস্যাক। একেবারে যুদ্ধসাজ! স্যার, স্লামালেকুম। আপনাকে অনারারি ক্যাপ্টেন তোফায়ে সবদিছে। অনারারি ক্যাপ্টেন হলো সুবেদার। সে একজন মেজরকে সালাম দেয় কীভাবে? সালাম দেওয়া মানে তো ডেকে পাঠানো! রেজার সন্দেহ হলো। সেনাবাহিনীর ইতিহাস তো জানা, কখন কে কোথায় বিদ্রোহ করে।
তোফায়েল সাব সালাম দিছে- এর মানে কী? হ স্যার, সব অফিসার অফিসে আসতেছে।
তুই কারে কারে দেখছস? আমি স্যার কাউকে দেখি নাই।
সব অফিসার আসতেছে! তুই কাউরে দেখস নাই!
মেজর মোজাফফররে দেখছি।
রেজা ঝটপট ইউনিফর্ম পরে অফিসের দিকে গেলেন। অফিস হাঁটাপথে
কাছেই। গেটের বাইরে যেতেই মিলিটারি চেকপোস্টে তাঁকে একটা স্যালুট দিল মনে হলো অতি উৎসাহ কিংবা ভয়। খুব জোরে শব্দ করে সে পা ঠুকল। কাছেই একটা ব্যাটালিয়নের কোয়ার্টারগার্ড। সেখানে আবার স্যালুট।
গলা সপ্তমে চড়িয়ে,
সালাম স্যার!
ঘটনা কী?
বাইর হইয়া দেখেন স্যার।
রেজা দেখলেন, ট্রাকভর্তি সৈনিকেরা যাচ্ছে। সবাই যুদ্ধসাজে। যুদ্ধ লাগলে যেভাবে কনভয় বের হয়, ঠিক সে রকম। লরি ঢুকছে, আবার বের হচ্ছে। মনে হলো, লড়াই বেধে গেছে।
অফিসে ঢোকার সময় আবার স্যালুট। এমন গর্জন, মনে হয় গলার রগ ছিড়ে যাবে। অফিসের বারান্দায় লে. কর্নেল মতিউর রহমান দাঁড়িয়ে। হাতে স্টেনগান। হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলছেন। হাই রেজা, হয়ার হ্যাভ ইউ বিন?
স্যার, বাসায় ছিলাম।
আরে মিয়া, তোমারে তো সময়মতো পাওয়া যায় না? একটু বৃষ্টি হলেই রেজার বাসার টেলিফোন লাইন আর কাজ করে না।
রোদ উঠলেই আবার ঠিক হয়ে যায়। আগের রাতে অনেক বৃষ্টি হয়েছে। নাইট ট্রেনিং থেকে বাসায় ফেরার পর তাঁর স্ত্রী বলেছিলেন, তোমাকে তো জি-ওয়ান সাহেব খুঁজেছিলেন। রেজা ফোনের রিসিভার উঠিয়ে দেখলেন, কোনো শব্দ নেই ডেড। েেল. কর্নেল মতি ছিলেন জিওসি জেনারেল। মনজুরের জি-ওয়ান অপস (অপারেশন)। তিনি খোঁজ করেছিলেন। ফোন ডেড থাকায় তার সঙ্গে রাতে আর যোগাযোগ হয়নি। এরপর ঘুমিয়ে
পড়েন রেজা। সকালে দেখা হওয়ামাত্রই কর্নেল মতি রেজাকে আগের রাতে খোঁজ করার
কথা বললেন। ডু ইউ নো, প্রেসিডেন্ট হ্যাজ বিন কিলড?
এইমাত্র শুনলাম। হ্যাঁ, প্রেসিডেন্ট হ্যাজ বিন কিলড। এখন আমাদের যত মুক্তিযোদ্ধা আছে, সবাইকে একসঙ্গে থাকতে হবে।
ঠিক আছে, থাকলাম। তুমি সার্কিট হাউজে যাও। সেখান থেকে প্রেসিডেন্টের ডেডবডি নিয়ে
পাহাড়ে যাবা। পাহাড়ে গিয়া কবর দিয়া আসবা।
আমাকে স্যার অন্য কাজ দেন। (পাশে দাঁড়ানো একজন অফিসার বললেন) মেজর শওকত আছে। সে যাক।
অ্যাই শওকত, কাম হিয়ার। তুমি প্রেসিডেন্টকে পাহাড়ে নিয়া কবর দিবা। রেজা, তুমি ওর সঙ্গে যাও। সার্কিট হাউজে গার্ড রেজিমেন্টের যারা আছে, তাদের সবাইকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়া আসবা। তাদের বলবা, থাকা তোমাদের জন্য সেফ না। সার্কিট হাউজে
যারা তাঁর সঙ্গে খেলাধুলা করে, তাদের কয়েকজনকে বেছে বেছে তাঁর পিকআপে তুললেন রেজা। শওকত তাঁর লোকজনকে নিয়ে উঠলেন একটা জিপে, সঙ্গে একটা পিকআপ। তাঁরা রওনা হলেন। সার্কিট হাউজে পৌঁছে শওকত দ্রুত সিঁড়ি টপকে উঠে গেলেন দোতলায়। নিচে দাঁড়িয়ে রেজা চিৎকার করে বললেন, গার্ড রেজিমেন্টের কে কোথায় আছ, এদিকে আসো। একজন সুবেদার দৌড়ে এসে স্যালুট দিয়ে বলল, স্লামালেকুম স্যার, আমরা স্যার আপনাদের দলে।
যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের বুকে নানা রকমের মেডেল থাকে। রেজা দেখলেন, এই সুবেদারের বুকে কোনো মেডেল ঝোলানো নেই, তার মানে সে পাকিস্তান-প্রত্যাগত, মুক্তিযোদ্ধা নয়।
সুবেদার সাহেব, আপনার বাড়ি কই? স্যার, বগুড়া।
প্রেসিডেন্টের বাড়ি কই?
বুঝছি। আপনি প্রেসিডেন্টের গেরাই (দেশি)। আপনাকে আনছে নিরাপত্তা দিতে। রাতে প্রেসিডেন্ট মারা গেল, আর সকালেই আপনি বলতেছেন- স্যার, আমি আপনাদের দলে। কথাটা কি ঠিক হইল?
(চলবে…)
সূত্র মানবজমিন