বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের বাজার ইয়াবার দখলে থাকলেও সম্প্রতি সময়ে সবচেয়ে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছে ক্রিস্টাল মেথ (আইস)। আগে ইয়াবার বড় চালানগুলো বাকিতে বাংলাদেশে পাঠানোর খবর পাওয়া গেলেও, কোটি কোটি টাকার আইসের বেলাতেও একই পন্থা অবলম্বন করছে কারবারিরা। বাংলাদেশের মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে বাকিতেই তুলে দেয়া হচ্ছে বড় বড় আইসের চালান। পরে সেগুলো বিক্রি করে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে মিয়ানমারে। আবার অনেক সময় হাতে হাতেও টাকা পাঠানো হচ্ছে। মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থেকে দেশের সর্ববৃহৎ আইসের চালানসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য জানিয়েছে র্যাব।
এরআগে, গত বুধবার দিবাগত রাতে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া এলাকায় মাদকের চালান নিয়ে আসার সময়ে ৫০ কোটি টাকা মূল্যের ১২ কেজি আইসসহ চক্রের ৫ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১৫ এর একটি দল। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- চক্রের মূলহোতা জসিম উদ্দিন ওরফে জসিম, তার অন্যতম সহযোগী মকসুদ মিয়া, রিয়াজ উদ্দিন, শাহিন আলম ও সামছুল আলম। তাদের সবার বাড়ি কক্সবাজারের সোনাদিয়ায়। এসময় তাদের কাছ থেকে আইস ছাড়াও এক লাখ পিস ইয়াবা, ৪ হাজার ৬০০ পিস চেতনানাশক মাদক সিডাকটিভ ইনজেকশন, দুটি বিদেশি পিস্তল, নয় রাউন্ড গুলি, দুটি টর্চলাইট, মিয়ানমারের সিমকার্ড, এক লাখ ৬৪ হাজার বাংলাদেশি টাকা ও এক লাখ মায়ানমারের মুদ্রা এবং ৫টি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়।
র্যাব বলছে, কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপ থেকে গভীর সমুদ্রে জেলের ছদ্মবেশে মাছ ধরার আড়ালে ক্রিস্টাল মেথ (আইস) ও ইয়াবা সংগ্রহ করে বিভিন্ন কৌশলে রাজধানী ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ ও বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে সরবরাহ করে আসছিল। এই চক্রে মোট ১০ থেকে ১৫ জন সদস্য রয়েছে। অভিযানের সময় ৫ জন গ্রেপ্তার হলেও কয়েকজন সদস্য পালিয়ে গেছে। তাদের গ্রেপ্তারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কামন্ডার খন্দকার মঈন বলেন, এ চক্রের হোতা মো. জসিম উদ্দিন ওরফে জসিম লবন ব্যবসার আড়ালে আইসের কারবার করে আসছিল। মিয়ানমার থেকে সমুদ্রপথে সোনাদিয়া হয়ে তার লবণের আড়তের আড়ালে আইস মজুদ করে রাখতো সে। পরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সিডাকটিভ এ মাদক ছড়িয়ে দিত এ চক্রের সদস্যরা। জেলের ছদ্মবেশে গভীর সমুদ্রে মাদকের চালান সংগ্রহ করা হতো। আর সংকেত হিসেবে টর্চের লাল ও সবুজ আলো ব্যবহার করতো তারা।
জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, সাগর পথে মাদকের চালান গ্রহণ ও নিরাপদ স্থলে পৌঁছানোর জন্য এ চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে প্রায় ২০-২৫ দিন জেলেদের ছদ্মবেশ নিয়ে গভীর সমুদ্রে অবস্থান করে থাকে। মালামাল গ্রহণের পর সুবিধাজনক সময়ে তারা সোনাদিয়া দ্বীপে চলে আসে। এরপর সুবিধাজনক সময়ে চক্রটি সোনাদিয়া হতে দুইটি বোটের মাধ্যমে নোয়াখালীর হাতিয়াতে ক্রিস্টাল আইস ও ইয়াবার চালান নিয়ে আসত। পরে ইঞ্জিন চালিত নৌকায় মেঘনা নদী হয়ে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া-ঢাকার আশেপাশে অথবা সুবধিাজনক স্থানে পৌঁছাত। ঢাকা ছাড়াও এরা বরিশাল, পটুয়াখালী ইত্যাদি অঞ্চলে মাদক সরবরাহ করতো। মাদকের চালান মুন্সিগঞ্জে পৌঁছানোর পর রাজধানীর একটি চক্র আইস ও ইয়াবার চালান গ্রহণ করে বিভিন্ন মাধ্যমে কৌশলে মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে।
কমান্ডার মঈন বলেন, গ্রেপ্তাররকৃত জসিম ৫/৭ বছর যাবত মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। সে লবন ব্যবসার আড়ালে আইসের কারবারে জড়িত। সে মূলত মিয়ানমারের মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করত। প্রথমে ইয়াবা আনলেও গত বছর থেকে তারা মিয়ানমার থেকে ক্রিস্টাল আইস নিয়ে আসাও শুরু করে। এছাড়াও জসিম রাজধানী থেকে কয়েকটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেতনানাশক মাদক সিডাকটিভ ইনজেকশন সংগ্রহ করে নৌপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিতো।
গ্রেপ্তারকৃত শাহীন আলম জসিমের অন্যতম প্রধান সহযোগী। সে সাগর ও নৌপথে মাদক পরিবহনের মূল দায়িত্ব পালন করে। তার বিরুদ্ধে মহেশখালী থানায় মানব পাচার ও মারামারি সংক্রান্ত ২টি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত অপর সদস্য শামছুলের বিরুদ্ধে মহেশখালী থানায় অস্ত্র ও মারামারি সংক্রান্ত ৩টি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত মকসুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও ডাকাতি সংক্রান্ত ৬টি মামলা রয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত শাহীন, সামসু ও মকসুদ মাদক বহন ও নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করত। আর রিয়াজ উদ্দিন মাদক পরিবহনে নজরদারীর জন্য স্কর্ট বোটে অবস্থান করত ও স্কর্টিং এর দায়িত্ব পালন করে থাকত।