রাজধানীর ডেমরায় চাঞ্চল্যকর সোহেল রানা (৩৫) হত্যাকাণ্ডে পাঁচ আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তারা বলেছে, ‘স্বামী, ভাসুর এবং তিন দেবরকে নিয়ে সরাসরি কিলিং মিশনে অংশ নেয় পুষ্প আক্তার (১৯) নামের গৃহবধূ। সোহেল রানা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেনি তার করুণ পরিণতির কথা। সোহলের বিশ্বাস হচ্ছিল না যে, তার প্রেমিকা পুষ্প বিয়ে করেছে। তাই তিনি প্রেমিকার বাড়িতে গিয়ে নিজ চোখে দেখতে চেয়েছিলেন আসলে পুষ্প বিয়ে করেছে কিনা। সেখানে গিয়ে লাশ হতে হয়েছে তাকে।’ পুলিশ ছয় ঘাতকের পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে। পুষ্পসহ তারা ৩০ ডিসেম্বর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে উঠে এসেছে হত্যাকাণ্ডের আদ্যোপান্ত।
পুষ্প ছাড়াও অন্য যারা জবানবন্দি দিয়েছে তারা হল, পুষ্পের স্বামী আল আমিন, ভাসুর রুহুল আমিন, দেবর বিল্লাল হোসেন এবং সোলায়মান। হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া পুষ্পের অপর দেবর শাহাদাৎ হোসেন এখন পলাতক।
আদালত সূত্র জানায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রশিদুল আলমের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে পুষ্প আক্তার। পুষ্প বলেছে, প্রায় দেড় বছর আগে সোহেল রানা আমাকে ড্যানিশ কোম্পানিতে চাকরি দেয়। এরপর থেকে সে আমার সঙ্গে নোংরা কথা বলতে থাকে। আমার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করতে চায়। আমি এতে রাজি হইনি। এ কারণে ৩ দিন চাকরি করার পর চাকরি ছেড়ে দিই। পরে আল-আমিনের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। এরপর দীর্ঘদিন সোহেলের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু তার নম্বর আমার কাছে ছিল (আমার অজান্তে)। আমি তার নম্বরকে আমার বান্ধবী প্রিয়ার নম্বর ভেবে একদিন ফোন করি। তখন বুঝতে পারি, এটা প্রিয়ার নম্বর না। এটা সোহেল রানার নম্বর। তাৎক্ষণিকভাবে ফোনে অমি সোহেল রানাকে চিনতে না পারলেও সে আমাকে চিনতে পারে। সে আমাকে তার সঙ্গে দেখা করতে বলে। এরপর সে আমাকে মাঝেমধ্যেই ফোন দিয়ে অশালীন কথাবার্তা বলে। আমি আমার স্বামীর ভয়ে তার সঙ্গে খুব একটা কথা বলতে চাইতাম না।
পুষ্প আরও বলে, মোবাইল ফোনে কথোপকথনের সময় সোহেল আমাকে গুলিস্তানে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করতে বলে। আমি রাজি হইনি। সোহেলের সঙ্গে কথোপকথনের বিষয়টি আমার অজান্তেই মোবাইল ফোনে রেকর্ড হচ্ছিল (স্বামী অটো রেকর্ডিং সিস্টেম চালু করে রেখেছিল)। এসব কথোপকথন শোনার পর আমার স্বামী আমাকে মারধর করে। স্বামী আল-আমিনকে বলি, আমি সোহেলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাই না। সে আমাকে ডিসটার্ব করে। বিষয়টি নিয়ে আমার স্বামী তার ভাইদের সঙ্গে আলোচনা করে। একপর্যায়ে সবাই মিলে আমাকে দিয়ে সোহেলকে ডেকে আনতে বলে। সে অনুযায়ী আমি তাকে (সোহেল) আমার কাছে আসতে বলি। সোহেল ডেমরায় অবস্থিত বাসার পাশে জমজম রেস্টুরেন্টে এলে তার সঙ্গে আমার দেখা হয়। তখন আমি তাকে চিনতে পারি। ওই সময় সে আমার বাসায় যেতে চায়। আমি তাকে বলি, বাসায় আমার স্বামী আছে। সেখানে গেলে সমস্যা হবে। এ সময় সে বলে, আমি বিশ্বাস করি না যে, তোমার বিয়ে হয়েছে। তোমার বাসায় গেলেই প্রমাণ হবে যে, তুমি বিয়ে করেছ নাকি একা থাকো। পরে সে আমার বাসায় যায়।
পুষ্প বলে, সোহেল বাসায় যাওয়ার পর সে প্রথমে আমার কাছে পানি চায়। আমি তাকে পানি দেওয়ার পর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আমার ভাসুর রুহুল আমিন, দেবর বিল্লাল হোসেন এবং সোলায়মান বাসায় আসে। তারা সোহেল রানার পরিচয় জানতে চায়। এ নিয়ে আমার ভাসুর-দেবরদের সঙ্গে সোহেল রানার কথা কাটাকাটি হতে থাকে। হঠাৎ সোহেল রানা সবাইকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় আমার স্বামী আল-আমিন এবং দেবর শাহাদাৎ ঘটনাস্থলে আসে। তখন সবার মধ্যে ধস্তাধস্তি ও চিৎকার-চ্যাঁচামেচি হয়। ঘটনার একপর্যায়ে আমার স্বামী আল-আমিন এবং দেবর বিল্লাল আমার ওড়না নেয়। পরে শাহাদাৎ, রুহুল আমিন, সোলায়মান, আল-আমিন এবং বিল্লাল মিলে সোহেলের গলায় ওড়না প্যাঁচিয়ে দুদিক থেকে টান দেয়। এতে সোহেল মারা যান।
জবানবন্দিতে পুষ্প আরও বলে, বাসার গেটের সামনে থেকে একটি অটোরিকশা আগে থেকেই অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছিল। সোহেল মারা যাওয়ার পর লাশ অটোরিকশা দিয়ে বাসার পাশে ডেমরা পূর্ব বক্সনগরের দারুন নাজাত কামিল মাদ্রাসার সীমানা প্রাচীরের বাইরে নির্মাণাধীন ভবনের চিপা গলিতে ফেলে দেয়।
একই দিনে ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেনের আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় পুষ্পের স্বামী আল-আমিন। এদিন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রহমান সিদ্দিকীর আদালতে রুহুল আমিন, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নুরুল হুদা চৌধুরীর আদালতে সোলায়মান এবং মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রশিদের আদালতে দোষ স্বীকার করে জবানবন্দি দেয় বিল্লাল হোসেন।
আল-আমিন তার জবানবন্দিতে বলে, পুষ্প আক্তারের মোবাইল ফোন ছিল না। আমার ফোন দিয়েই সে কথা বলত। আমি বাসায় ফোন রেখে বাইরে গেলেই সে সোহেল রানার সঙ্গে আপত্তিকর কথাবার্তা বলত। তাকে বারবার এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেও সন্তোষজনক জবাব পাইনি। তাই একদিন আমি আমার ফোন নিয়ে মেকারের কাছে গিয়ে ফোনে অটো রেকর্ডিং সিস্টেম চালু করে রাখি। বিষয়টি পুষ্প জানত না। তাই সে বরাবরের মতো আমার অগোচরে সোহেল রানার সঙ্গে কথা বলতে থাকে। কয়েকদিন পর আমি বাসার বাইরে গিয়ে দুজনের কথোপকথনের রেকর্ড শুনি। এতে অনেক অশালীন কথাবার্তা ছিল। সোহেল আমার স্ত্রীর বাসায় বেড়াতে এসে কয়েকদিন থাকতে এবং শারীরিক সম্পর্ক করতে চায়। এসব কথোপকথন শুনে আমার মন ভীষণ খারাপ হয়ে যায়। আমার স্ত্রীকে মারধর করি। পরে তাকে বলি সে যেন সোহেলকে বাসায় নিয়ে আসে। এতে সে রাজি হয়। আমার শিখিয়ে দেওয়া কথা অনুযায়ী সে সোহেলকে বাসায় আসতে বলে। বাসায় আসার জন্য ২৫ ডিসেম্বর দিন নির্ধারণ করা হয়। সোহেল বাসায় এলে আমার ভাই রুহুল আমিন, সোলেমান, শাহাদাৎ ও বিল্লাল সেখানে আসে। তারা সোহেলকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। এরই মধ্যে আমি বাসায় আসি। আমি বাসায় আসার পর সেখানে সোহেলকে দেখেই মাথা গরম হয়ে যায়। মেজাজ হারিয়ে তাকে চড়, থাপ্পড় ও কিল-ঘুষি মারতে থাকি। একটি লাঠি দিয়েও আঘাত করি। ওই সময় সে উত্তেজিত হয়ে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করতে থাকে। তখন আমরা সবাই মিলে যে যার মতো তাকে মারতে থাকি।
জবানবন্দিতে আল-আমিন আরও বলেন, বাগবিতণ্ডার একপর্যায়ে আমি আমার স্ত্রীকে বলি, সোহেলের সঙ্গে যদি তার কোনো সম্পর্ক না থাকে তাহলে সে যেন তাকে (সোহেল) পেটায়। আমার কথা অনুযায়ী, সে সোহেলকে পেটাতে শুরু করে। ওই সময় আমি আমার স্ত্রীর ওড়না নিয়ে সোহেলের গলায় প্যাঁচিয়ে ধরি। ওড়নার একদিকে আমি টান দিই। অন্যদিকে টান দেয় বিল্লাল। এতে সোহেলের মৃত্যু হয়। এরপর পাঁচ ভাই মিলে রাত ১২টার দিকে সোহেলের লাশ অটোরিকশায় গুম করি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পরিদর্শক শফিকুল ইসলাম বলেন, সোহেল হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি খুবই চাঞ্চল্যকর ছিল। ডিবি ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন এবং ডেমরা জোনাল টিমের অতিরিক্ত উপকমিশনার আজহারুল ইসলাম মুকুলসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের যথাযথ দিকনির্দেশনায় দ্রুততম সময়ের মধ্যেই ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে। ২৯ ডিসেম্বর ভোর থেকে ৩০ ডিসেম্বর ভোর পর্যন্ত টানা দুদিনের অভিযানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাঁচ আসামিকে গ্রেফতার করা হয়। পালিয়ে থাকা অপর আসামিকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।