জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন দেশের ১০ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠান। এ বছর সাহিত্যে স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন মাগুরার প্রয়াত চারণকবি মো. আমির হামজা। স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় তার নাম আসায় জেলার সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বইছে।
জানা গেছে, কৈশোরে বাবাকে হারানোর কারণে কবি মো. আমির হামজার লেখাপড়া বেশি দূর এগোয়নি। মাত্র অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার সুযোগ হয়েছিল তার। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। গান ও কবিতা লিখতেন। নিজেই সুর করে আবার নিজেই গায়ক হিসেবে তিনি তা মঞ্চে পরিবেশন করতেন। কবি গান ও ভাব গানের জন্য ব্যাপক খ্যাতি ছিল তার। জীবদ্দশায় লিখেছেন অনেক গান ও কবিতা। ফলে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য মৃত্যুর পর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি।
মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত ১০ ব্যক্তি ও একটি প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে সাহিত্যে মাগুরার শ্রীপুরের স্বভাব কবি মরহুম মো. আমির হামজার নাম রয়েছে। এতে খুশি এলাকাবাসী।
কবি পরিচিতি
কবি মো. আমির হামজা মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার ৩ নম্বর শ্রীকোল ইউনিয়নের বরিশাট গ্রামে ১৯৩১ সালের ৩ মে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইমারত সরদার আর মা আবিরণ নেছা। তিনি কাজীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর ভর্তি হন শ্রীপুর মহেশ চন্দ্র পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর আর লেখাপড়া এগোয়নি। কবি বিবাহিত ছিলেন। তার ৬ ছেলে ও ৪ মেয়ে। সন্তানদের মধ্যে এক মেয়ে মারা গেছেন।
২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি কবি মো. আমির হামজা পরলোকে গমন করেন। তার ছেলেদের মধ্যে মো. আসাদুজ্জামান বর্তমানে খুলনা জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। মূলত তার চেষ্টায় কবির কাব্যগ্রন্থগুলো প্রকাশিত হয়। বইগুলো আসাদুজ্জামান দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের হাতে উপহার হিসেবে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
সাহিত্যকর্ম
জীবদ্দশায় কবি মো. আমির হামজা অনেক গান ও কবিতা লিখেছেন। ২০১৭ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বাঘের থাবা’ প্রকাশিত হয়। কবি জীবিত থাকতেই এই কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সেখানে ৩৫টি কবিতা এবং ৩৬টি গান আছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা গ্রন্থটি ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। এরপর মুজিববর্ষ উপলক্ষে ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি’ শীর্ষক গানের বইটি কবির প্রকাশিত দ্বিতীয় গ্রন্থ। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবন ও তার অবিনাশী রাষ্ট্রদর্শন এখানে উঠে এসেছে। বইটিতে মোট গানের সংখ্যা ৫২টি। এর অধিকাংশই দেশের স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা।
কবি আমির হামজা রচিত বই
মাগুরার শ্রীপুরের ‘সারথি কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ নামে একটি সংগঠন বইটি প্রকাশ করে। পরবর্তীতে ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব’ নামে আরেকটি বই প্রকাশিত হয়। যেখানে কবি রচিত ৫২টি গান রয়েছে। এছাড়া ‘একুশের পাঁচালী’ নামে প্রকাশিত আরেকটি বই প্রকাশিত হয়। সেখানে ২৫টি কবিতা রয়েছে।
কবি মো. আমির হামজার ছেলে মো. আসাদুজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে এককভাবে কবি মো. আমির হামজার মতো এত গান আর কবিতা আর কেউ লেখেননি।
বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে আমির হামজা রচিত গান ও কবিতা
‘যে ক্ষতি পারোনা তুমি করিতে পূরণ
কেন সেই মহাপ্রাণ করিলে হনন
কারে নিয়ে বল আজ কবিতা লিখি
একটি মুজিব এনে দাও তো দেখি।’
জনপ্রিয় এবং সমাদৃত এই গানের মত কবি আমির হামজা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কবিতাও লিখেছেন। তার উল্লেখযোগ্য গান ও কবিতা গুলো হচ্ছে-
১.
ওগো বিশ্ব নেতা
যেদিন তুমি এলে মোদের মাঝে
সে যে কাল বৈশাখী ঝড়ে
এই অলস জাতির ঘুম ভাঙিল অনেক দিনের পরে
তোমার ভাষণে।
২.
শোনো শোনো খুকু মনিরা শোনো নবাগতরা শোনো
তোমরা যারা দেখো নাই তারা শোনো
এক বীর শিকারির কথা, সেই শিকারি মারতো শুধু বাঘ
তার সারা গায় ভরা ছিল বাঘের থাবার দাগ।
৩.
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা
যদি একবার চোখে দেখতে।
শেক্সপিয়ার, মিল্টন, বায়রন- শেলী
অনেক কবিতা লিখতে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়েও কবি আমির হামজা অনেক কবিতা ও গান লিখেছেন। এর মধ্যে একটি হচ্ছে-
১.
আবারো ভাসিছে আযানের ধ্বনি
শেখ হাসিনার আহ্বান
ক্লান্ত শ্রমিক, মাঝিরা, চাষিরা
ফিরিয়া পেয়েছে প্রাণ
সে যে শেখ হাসিনার আহ্বান
শত বাহুতুলে হাসিছে শাপলা বাংলার সরোবরে।
লেখক, সুরকার ও গায়ক আমির হামজা
কবি আমির হামজা একাধারে কবি, গীতিকার ও সুরকার। তিনি কেবল গীতিকবি নন, নিজে গাইতেনও। প্রতিযোগিতামূলক কবিগান ও পালাগান করে অনেক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তার একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য ছিল গানের আসরেই গান লিখে ও সুর করে পরিবেশন করতে পারতেন। তার কবি জীবনের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো তিনি তাৎক্ষণিক দেশ ও জাতির হয়ে শ্রোতার চাহিদা অনুযায়ী গান লিখে পরিবেশন করতেন।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শ্রীপুর বাহিনীতে যোগ দিয়ে গৌরবময় ভূমিকা পালন করেন কবি আমির হামজা। তার নিজ বইয়ের লেখক পরিচিতিতে মুক্তিযুদ্ধের অঙ্কুর অংশগ্রহণের বিষয়টি লেখা আছে। মূলত বাহিনী তথা আকবর বাহিনীর অধিনায়ক আকবর হোসেন মিয়ার আহ্বানে তিনি মুক্তিযুদ্ধে একজন গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে সক্রিয় হবে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেন।
এদিকে মাগুরার মতো ছোট জেলার একজন কবিকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদানে আনন্দ প্রকাশ করেছেন এলাকার কবি, সাহিত্যিক ও সাধারণ মানুষ। মাগুরার সাংস্কৃতিক সংগঠন সুরধ্বনি সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রের পরিচালক কবি ও সংগীত শিল্পী বাসনা রায় বলেন, আমরা যারা ছোট শহরে কিংবা গ্রামে বাস করি। সাধারণত তাদের প্রতিভা বিকশিত হওয়ার সুযোগ কম থাকে। সেক্ষেত্রে শ্রীপুরের বরিশাট গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ও কবি আমির হামজার এ পুরস্কার প্রাপ্তি আমাদের জন্য গর্বের।
শ্রীপুরের সাংস্কৃতিক সংগঠন সারথি কল্যাণ ফাউন্ডেশনের সভাপতি শিকদার মঞ্জুর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, চারণ কবি আমির হামজার এ পুরস্কার প্রাপ্তিতে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত। তিনি আমৃত্যু আমাদের সংগঠনের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করে গেছেন। তার এ পুরস্কার প্রাপ্তি আমাদের সংস্কৃতি চর্চায় আরও উৎসাহিত করবে।