রাত হলেই লাশ হাঁটে। কবর থেকে উঠে এক স্থানের লাশ চলে যায় অন্য স্থানে। এমন কথা মিরপুরের সাধারণ মানুষের মুখে মুখে। কবরস্থান পরিচালনা কর্তৃপক্ষের মুখে এমন কথা তারা শুনেন হরহামেশা। তাই দাফনের কয়েক দিন পর কবর খুঁজে না পেলেও হতভম্ব হন না তারা। তবে কবর ঠিক রাখতে অনেকেই দেন মোটা অঙ্কের টাকা। বিষয়টি এখন ওপেন সিক্রেট। এমনকি অর্থের বিনিময়ে ঘটে আরও ভয়ানক কাণ্ড। ধন-সম্পত্তি মালিকানা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে অনেকেই মৃত মানুষকে জীবীত দেখাতে চান আবার মামলা সংক্রান্ত কারণে অনেকে জীবীত মানুষকেও মৃত দেখাতে চান। সফলও হন কেউ কেউ। এতে জড়িত এই কবর বাণিজ্যকারী সিন্ডিকেট। এছাড়াও কবরস্থান বিক্রিতে ঘটছে অবাধ বাণিজ্য।
অনুসন্ধানকালে জানা গেছে, মিরপু-১১ এর পল্লবীর জান্নাতুল মাওয়া কবরস্থানের নামফলক অনুসারে এক নারীর ‘মৃত্যু’ হয়েছে দু’বার। তিনি মিরপুর-১০ এর ১০-এ লেন ১/১০ এর বাসিন্দা রওশন আরা। কবরস্থানের একটি নাম ফলক অনুসারে তার মৃত্যু হয়েছে ২০১৩ সালের ১৬ মার্চে। স্টেইনলেস স্টিলের রেলিং ও ক্রংক্রীট দিয়ে বাঁধাই করা হয় তার কবর। কিন্তু কিছু দিন পরেই সেই কবরটি নিশ্চিহৃ হয়ে যায়। রহস্যজনকভাবে পাঁচ বছর পরে একই স্থানে আবার ঝুলানো হয় মরহুমা রওশন আরার নাম ফলক। এতে উল্লেখ করা হয়েছে তার মৃত্যু হয়েছে ২০১৯ সালের ১৬ মার্চ। ২০১৩ সালের সেই কবরের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তবে আমাদের কাছে রয়েছে, সেই কবরের তথ্য ও আলোকচিত্র। এর রহস্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেছে, কবরস্থান কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করেই পুরনো কবর ও মৃত্যুর তারিখ আড়াল করেছেন রওশন আরার সন্তানরা। মিরপুরের এই নারীর নামে মিরপুরসহ বিভিন্নস্থানে সম্পত্তি রয়েছে। এই সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ ছিলো ছেলে জুয়েল ও তার দুই বোনের মধ্যে।
অভিযোগ রয়েছে, নিজের নামে সম্পত্তি নিতেই ওই সময়ে বিভিন্ন দলিল সম্পাদনা করা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করতে চাননি। সরজমিনে মিরপুরের বাসায় গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে রওশন আরার পরিবারের কেউ থাকেন না। ওই বাড়িতে চলছে বহুতল ভবন নির্মাণ কাজ। রওশন আরার ছেলেকে সবাই জুয়েল নামেই চিনেন। তিনি থাকেন বারিধারা ডিওএইচএস এলাকায়। বারিধারা ডিওএইচএস এলাকার তিন নম্বর সড়কের ২৫৭ নম্বর বাড়িতে রয়েছে তার একটি অফিস। সেখানে গেলেও তিনি দেখা করেননি। এ বিষয়ে কথা বলতে চাননি কেউ। তবে ফোনে যোগাযোগ করলে বিষয় জেনেই জুয়েল উত্তেজিত হয়ে উঠেন। তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ। আপনাদের আর কোনো কাজ নেই। কে কখন মরলো, এসব খোঁজ করার মানে কি।’ বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি।
জানা গেছে, নানা রোগে আক্রান্ত ছিলেন রওশন আরা। ২০১৩ সালে মৃত্যুর আগে তাকে মিরপুর-১০ এর ডা. আজমল হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। পরবর্তীতে তার মৃত্যু ঘটে। আজমল হাসপাতালে যোগাযোগ করা হলে এত আগের কাগজপত্র পাওয়া দুষ্কর বলে জানান কর্তৃপক্ষ। তবে রওশন আরার প্রতিবেশী মোহাম্মদ ইমরানসহ অনেকেই জানান, ২০১৩ সালে মৃত্যু হয়েছে রওশন আরার। তবে জান্নাতুল মাওয়া কবরস্থান কর্তৃপক্ষ জানান তাদের কাছে এ ধরণের কোনো তথ্য নেই। শুরুতে কৌশলে ওই বছরের নথি দেখতে চাইলে সময়ক্ষেপন করেন হাফেজ মাওলানা নুরুজ্জামান। শেষ পর্যন্ত তিনি জানান, এমন কোনো তথ্য নেই তাদের কাছে। এ বিষয়ে কবরস্থান ও এতিমখানা মাদ্রাসা কমপ্লেক্স’র সাধারণ সম্পাদক আমানত হোসেন আমান বলেন, এত আগের কথা মনে নেই। তবে আমাদের এখানে কোনো অবৈধ কাজ হয় না। ‘রাত হলেই লাশ হাঁটে’ আমানত হোসেন আমানতের এই কথা মিরপুরের লোকজনের মুখেমুখে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুষ্টু লোকজন এসব বলে।
জানা গেছে, শুধু মিরপুর না কবর বাণিজ্য হচ্ছে, রাজধানী জুড়ে। ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, ১০ বছরের জন্য কবর সংরক্ষণে দিতে হয় পাঁচ লাখ টাকা। ১৫ বছর সংরক্ষণ করাতে চাইলে দিতে হবে ১০ লাখ টাকা। এছাড়া ২০ বছরের জন্য ১৫ লাখ এবং ২৫ বছরের জন্য ২০ লাখ টাকা। তবে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ১০ বছর পর্যন্ত বিনামূল্যে সংরক্ষণের সুযোগ রয়েছে। বিপুল টাকার বিনিময়ে ইচ্ছে থাকলেও বেশিরভাগই কবর সংরক্ষণ করতে পারেন না সাধারণ মানুষ। তবে অন্তত দুই বছর পর্যন্ত কবর দৃশ্যমান রাখার নিয়ম থাকলেও নির্দিষ্ট সময় পার না হতেই কবর নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় মৃতের স্বজনরা জিয়ারতের জন্য গিয়ে কবর না পেয়ে দুঃভভারাক্রান্ত হন। কবর নিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা বিপাকে পড়লেও অনেক বিত্তবান ব্যক্তি অগ্রিম কিনে রেখেছেন কবরের জায়গা।
অন্যদিকে বিশেষ বিবেচনায় কবর কেনার সুযোগ রেখেছে সিটি করপোরেশন। যার মূল্য ৫ লাখ থেকে শুরু করে ২৫ লাখ পর্যন্ত। তবে বিত্তবানরা ২৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত দিয়ে থাকেন। অনেক ক্ষেত্রেই এর কোনো বৈধ হিসাব নেই।
সম্প্রতি রাজধানীর আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা মেয়ের কবর জিয়ারত করতে যান মনির উদ্দিন। যেখানে কবরটি ছিল সেই জায়গায় তার মেয়ের কবরটি আর নেই। কয়েক মাসের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে মেয়ের নাম লেখা সাইনবোর্ডও। এই স্থানে এখন অন্য ব্যক্তির কবর। তার মেয়ের লাশটি তুলে অন্য একটি কবরের ভেতরে রাখা হয়েছে। কারণ, কবর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মাসে মাসে টাকা চান কর্তৃপক্ষ। তা দেননি মনির।
ভুক্তভোগী আমিন উদ্দিন জানান, আজিমপুর কবরস্থানে এক বছর আগে তার শিশু কন্যার লাশ দাফন করা হয়। তার আগে তার দাদাকেও এই কবরস্থানে সমাহিত করা হয়েছে। কবরস্থান কর্তৃপক্ষ জানান, কবর সংরক্ষণ করতে হলে দাফনের দুই বছর পর থেকে প্রতি মাসে টাকা দিতে হবে। টাকা দিয়ে কবর সংরক্ষণ করতে চাননি তিনি। কিন্তু করোনার প্রকোপ দেখা দিলে প্রতিদিন লাশের পরিমাণ বাড়তে থাকে। যে কারণে দুই বছর দূরে না হতেই তার মেয়ে ও দাদার কবর তুলে ফেলা হয়। দাফনের পর থেকেই নিয়মের বাইরে গিয়ে প্রতি মাসে ৫০০ থেকে ১০০০ হাজার টাকা করে দিতে হয়। তাছাড়া কবর দেবে গেলে বা কোনো পরিচর্যা করতে হলে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। এজন্য পাঁচ হাজার থেকে ২০ হাজার পর্যন্ত নেওয়া হয়। সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, প্রতি কবরের জন্য সাধারণ রেজিস্ট্রেশন ফি ধরা হয় এক হাজার টাকা। এছাড়া প্রতি কবরের বাঁশ, চাটাই ও কবর খননের ফিসহ লাশের সাইজ অনুযায়ী দাফনের খরচ পড়ে দুই হাজার থেকে দুই হাজার দুই শ’ টাকা। বাঁশ, চাটাই ও কবর খননের খরচ ডিএসসিসি কর্তৃক নিয়োজিত ঠিকাদারের নির্ধারিত মূল্যের মধ্যেই ধরতে হয়।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট দশটি সরকারি কবরস্থান রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় আজিমপুর কবরস্থান। এই কবরস্থানে সাধারণ কবরের ধারণ ক্ষমতা ২৫ হাজার। আর সংরক্ষিত কবর রয়েছে ২ হাজার ৬শ’। এই কবরস্থানের পাশেই শুধুমাত্র সংরক্ষিত কবরের জন্য তৈরি করা হয়েছে আরেকটি কবরস্থান। এখানে সংরক্ষিত রয়েছে দুই সহস্রাধিক কবর।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের বলেন, মৃতদের সবাই ঢাকায় দাফন করতে চান। এটা চলতে থাকলে কবরের জায়গা সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করবে। ঢাকায় কবর দিতে নিরুৎসাহিত করতে আমরা নানাভাবে চেষ্টা করছি। আমরা চাই মৃতদের ঢাকার বাইরে গ্রামে কবর দেয়া হোক।
একইভাবে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমাজ বিজ্ঞানী তৌহিদুল হক বলেন, সুষ্ঠুভাবে দাফণ সম্পন্ন করতে সরকারকে ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। এজন্য জনবহুল শহর ঢাকার বাইরে কবরস্থান এবং স্বল্প ব্যয়ে লাশ পরিবহনের ব্যবস্থা প্রয়োজন। নতুবা ভবিষ্যতে এটি প্রকট সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করেন তিনি।