দীর্ঘদিন ধরে সীমান্তে বিশাল সংখ্যক সেনা মোতায়েন করে রাখার পর ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত দু’টি রুশপন্থি অঞ্চলকে ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে মস্কো। এরপরই পূর্ব ইউরোপের এই দেশটি নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমা বিশ্বের উত্তেজনা পেয়েছে নতুন মাত্রা। এর জেরেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে একগুচ্ছ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে পশ্চিমা দেশগুলো।
এসব নিষেধাজ্ঞা আরোপকারী দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও জাপানসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মতো সংস্থাও রয়েছে। বুধবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যমটি জানিয়েছে, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত দু’টি রুশপন্থি অঞ্চলকে মস্কো ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ায় মঙ্গলবার সর্বশেষ দেশ হিসেবে রাশিয়ার ভিইবি এবং রুশ সামরিক বাহিনীর একটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞা রুশ সরকারকে পশ্চিমা দেশগুলো থেকে অর্থ সংগ্রহ বন্ধ করে দেবে।
বাইডেনের ভাষায়, ‘পশ্চিমা দেশগুলো থেকে এখন আর কোনো অর্থ পাবে না রাশিয়া।’ তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, রাশিয়া যদি তার বাহিনী নিয়ে পশ্চিমে ইউক্রেনের দিকে অগ্রসর হয়, তবে তাকে আরও নিষেধাজ্ঞাসহ আরও বেশি মূল্য দিতে হবে।
বিবিসি বলছে, রাশিয়ার প্রভাবশালী বেশ কিছু ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেত পারে যুক্তরাষ্ট্র। জো বাইডেন বলেছেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় মিত্রদেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে রাশিয়ার পাঁচটি ব্যাংকের সম্পত্তি ফ্রিজ করার ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। একইসঙ্গে তিনজন রুশ বিলিয়নিয়ারের বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দেশটি। নিষেধাজ্ঞার ফলে এই তিন রুশ ধনকুবের নাগরিক যুক্তরাজ্যে ভ্রমণ করতে পারবেন না এবং ব্রিটেনে থাকা তাদের সম্পদও আটকে রাখা যাবে।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সে এই পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করার সময় বেশ কিছু ব্রিটিশ আইনপ্রণেতা প্রধানমন্ত্রী জনসনের নেওয়া পদক্ষেপকে যথেষ্ট নয় বলে দাবি করেন। পরে জনসন দাবি করেন, নিষেধাজ্ঞার পরিধি আরও বাড়ানো হতে পারে।
এছাড়া ইউক্রেনে চলমান উত্তেজনার কারণে রাশিয়ার অন্যতম প্রধান গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে জার্মানি। রুশ এই গ্যাস পাইপলাইনটি নর্ড স্ট্রিম ২ নামে পরিচিত এবং এর মাধ্যমে রাশিয়ার গ্যাস জার্মানি তথা পশ্চিম ইউরোপে যাওয়ার কথা রয়েছে। অবশ্য রাশিয়ার সরবরাহ করা গ্যাসের ওপরই অনেকটা নির্ভরশীল পুরো ইউরোপ। সমগ্র ইউরোপের প্রায় ৪০ শতাংশ গ্যাসের জোগান দিয়ে থাকে রাশিয়া।
এদিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একগুচ্ছ নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। সংস্থাটির পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল বলেছেন, ইউক্রেনের দু’টি অঞ্চলকে ‘স্বাধীন রাষ্ট্র’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে রুশ পদক্ষেপের প্রতিক্রিয়ায় ইইউভুক্ত দেশগুলো সর্বসম্মতিক্রমে নিষেধাজ্ঞা আরোপের এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ব্রাসেলসে ইইউয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের জরুরি বৈঠকের পর মঙ্গলবার রাতে বোরেল নিষেধাজ্ঞার কথা ঘোষণা করেন। তিনি দাবি করেন, এই নিষেধাজ্ঞার ফলে রাশিয়া মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বোরেল বলেন, ‘ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের’ ঘটনায় জড়িত রাশিয়ার ২৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে বহির্বিশ্বের সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেন করতে রাশিয়া বাধাগ্রস্ত হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ইইউয়ের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান আরও বলেন, রাশিয়ার সেনারা বর্তমানে ইউক্রেনের ভূখণ্ডে অবস্থান করছে এবং এর অর্থ হচ্ছে- মিনস্ক শান্তিচুক্তির আর কোনো অস্তিত্ব নেই।
অন্যদিকে সরসরি হামলা না চালিয়ে ভিন্ন পন্থায় ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোর অভিযোগে রাশিয়ার ওপর প্রথম ধাপে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে কানাডা। স্বাধীন দেশ হিসেবে রাশিয়ার স্বীকৃতি পাওয়া দোনেতস্ক এবং লুহানস্কে সব ধরনের অর্থায়ন নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি রুশ পার্লামেন্ট সদস্যদের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে জাস্টিন ট্রুডোর সরকার।
স্থানীয় সময় মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণা দিয়ে কানাডীয় প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো বলেন, বাল্টিক অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখার পাশাপাশি ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষিত রাখতে লাটভিয়ায় কানাডার ৪৬০ সেনাসদস্য মোতায়েনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দোনেতস্ক ও লুহানস্কে রাশিয়ার সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্তেরও নিন্দা জানান তিনি।
একইসঙ্গে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত দু’টি রুশপন্থি অঞ্চলকে ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়াকে ইউক্রেনের অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের ওপর আক্রমণ বলেও অভিহিত করেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী। এছাড়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার কথা জানিয়েছে জাপানও। পূর্ব এশিয়ার এই দেশটির প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা জানিয়েছেন, নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে জাপানে রাশিয়ান বন্ড ইস্যু করা নিষিদ্ধ করা এবং কিছু রুশ নাগরিকের সম্পদ জব্দ করার পাশাপাশি জাপানে ভ্রমণ সীমিত করা।