১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর খোলনলচে বদলে যায় ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশের মানচিত্র। সোভিয়েত পতনের পর সেই ধ্বংসস্তুপ থেকে জন্ম নেয় রাশিয়ান ফেডারেশন। সদ্য জন্ম নেওয়া রাশিয়ার হাল ধরেন বরিস ইয়েলৎসিন। তবে তিনিও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। তার শাসনামলে রুশ ফেডারেশন বিশ্ব দরবারে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। ১৯৯৯ সালে ইয়েলৎসিন সরে যাওয়ার পর রাশিয়ার হাল ধরেন ভ্লাদিমির পুতিন। সেই থেকে সাবেক সোভিয়েত সময়ের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার ছক কষে যাচ্ছেন তিনি। অন্তত দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকাকালে পুতিনের নানা পদক্ষেপ সেই ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
চেচনিয়া যুদ্ধ থেকে শুরু করে আজকের ইউক্রেন অভিযান, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের খবরের খোরাক জোগাতে পুতিন কখনো কার্পন্য করেননি। ‘লৌহমানব’ পুতিন ক্ষমতায় আসার পর বারবার সামরিক অভিযানে জড়িয়েছে রাশিয়া। পুতিনের শাসনামলে মস্কোর সামরিক অভিযানের খতিয়ান দেখেই আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা পুতিনকে যুদ্ধবাজও বলে থাকেন। পুতিনের সময় রাশিয়া যেসব অভিযান চালিয়েছে তা দেখে নেওয়া যাক।
চেচনিয়া যুদ্ধ
সোভিয়েত পতনের পর টালমাটাল পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করে বসে রাশিয়ার চেচেনরা। ১৯৯৪ সালে চেচেন বিদ্রোহীদের দমন করে ওই অঞ্চলে সেনা পাঠায় মস্কো। তবে চেচেনদের কাছে সুবিধা করতে পারেনি রুশ বাহিনী। ১৯৯৬ সালে লেজ গুটিয়ে ফিরে আসে তারা। পরে পুতিন ক্ষমতা দখলের পর পরিস্থিতি পাল্টে যায়। পুতিন ক্ষমতা দখলের বছরই চেচেনদের তুলোধুনো করে ছেড়ে দেয় ‘লৌহমানব’ পুতিন। ২০০০ সালেই ফের রাশিয়ার দখলে চলে আসে চেচনিয়া। মূলত চেচেনদের বিরুদ্ধে এই বিজয় পুতিনের জন্য একটি মাইলফলক। এই বিজয়ের মাধ্যমে রাশিয়ায় নিজের অবস্থান শক্ত করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নিজের উপস্থিতি জানান দেন পুতিন।
রাশিয়া-জর্জিয়া যুদ্ধ
২০০৮ সাল। চেচেন যুদ্ধের পর কেটে গেছে আট বছর। রাশিয়ার দারুণ অবস্থান তৈরি করে নিয়েছেন পুতিন। এমন সময় সাউথ ওসেটিয়া নিয়ে জর্জিয়ার সঙ্গে সংঘাতে জড়ায় রাশিয়া। সাউথ ওসেটিয়ার বিতর্কিত অঞ্চলটির দখল ছিল রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাতে। সেই ভূখণ্ড ফের দখল করতে ২০০৮ আগস্টে অভিযান শুরু করে জর্জিয়া। তবে চুপ থাকার মানুষ নন পুতিনও। বিদ্রোহীদের সঙ্গে নিয়ে পাল্টা হামলা চালায় রুশ বাহিনী। সংঘাত চলে পাঁচ দিন। ওই সংঘাতে প্রাণ হারায় কয়েক হাজার মানুষ। পিছু হটে জর্জিয়া। ঠিক ইউক্রেনের লুনহাস্ক ও দোনেস্কের মতো বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে থাকা সাউথ ওসেশিয়া ও আবাকাজি প্রদেশকে ‘স্বাধীন’ বলে ঘোষণা করে রাশিয়া। তখন থেকে আজও সেখানে রুশ সেনা মোতায়েন রয়েছে।
ক্রিমিয়া দখল
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকেই ইউক্রেনে মস্কো বিরোধী মত মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মস্কোকে পাশ কাটিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ভালো বোঝাপড়া গড়ে ওঠে সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশটির একাংশের। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের গদিতে ছিলেন রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। তবে গণআন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ। চুপ ছিল না পুতিন বাহিনীও। ভিক্টর ইয়ানুকভিচ সরে যাওয়ার পর ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। রাশিয়ার এই আগ্রাসনের ফলে অখণ্ডতা নষ্ট হয় ইউক্রেনের।
ইউক্রেনে অভিযান
ক্রিমিয়া দখলের পর এবার ইউক্রেনের দিকে হাত বাড়িয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্যপদ দাবি করার পর দীর্ঘদিনের ‘শত্রুতার’ বদলা নেওয়ার অজুহাত পেয়ে যায় রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্বের হুমকি-ধামকি আমলে না নিয়ে ঠিক জর্জিয়ার পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে ইউক্রেনের ডোনবাস অঞ্চলের দোনেস্ক ও লুহানস্ককে ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রের মর্যাদা দেয় রাশিয়া। এমনকি সেখানে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য’ সেনা পাঠানোরও ঘোষণা দেন পুতিন। রাশিয়ার এই ঘোষণার ফলে ক্রিমিয়ার পর ফের দ্বিখণ্ডিত হলো ইউক্রেনের ভূখণ্ড।
সেই চেচনিয়া থেকে শুরু করে আজকের এই ইউক্রেন অভিযান– পশ্চিমাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে পুতিনের বারবার কঠোর সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ একদিকেই দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছে। পুতিন ‘হয়তো’ আবার ফিরিয়ে আনতে চান সেই দোর্দণ্ড প্রতাপশালী সোভিয়েত যুগকে। আর পুতিনের সেই লক্ষ্যের একটি পদক্ষেপই ‘হয়তো’ ইউক্রেনের এই হামলা। তবে সব ‘হয়তো’র জবাব সময়ই দেবে।