যুক্তরাজ্যে কোনও সতর্কতা ছাড়াই একজন ব্যক্তির নাগরিকত্ব বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে কর্তৃপক্ষের। এমনিভাবে প্রায় পাঁচ বছর আগে একজন ব্যক্তির নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাকে রাষ্ট্রহীন মানুষের পরিণত করেছিল দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিপক্ষে অবশেষে নিজের নাগরিকত্ব ফিরে পেয়েছেন ওই ব্যক্তি। তবে নিজের জীবনে ওই সিদ্ধান্তের বিধ্বংসী প্রভাবের কথা জানিয়েছেন তিনি। ২০১৭ সালে নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে আটকা পড়ে থাকার পর এ সপ্তাহে তিনি যুক্তরাজ্যে ফেরেন।
৪০ বছরের ওই ব্যক্তির জন্ম রাজধানী শহর লন্ডনে। ওই বছর নিজের দ্বিতীয় কন্যা সন্তানের জন্মগ্রহণকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে যাত্রার পরপরই তার নাগরিকত্ব কেড়ে নেয় ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ। আদালতের নথিতে ওই ব্যক্তিকে ই৩ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশে যাত্রা করার সময় তিনি যুক্তরাজ্যে কাজ করছিলেন। কিন্তু স্ত্রীকে লন্ডনে নিয়ে যেতে স্পন্সরের জন্য যে অর্থ প্রয়োজন তার উপার্জন ততটা ছিল না। এর মধ্যেই ব্রিটিশ নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হলে স্ত্রী এবং তিন কন্যাকে নিয়ে রাষ্ট্রহীন একজন নিঃস্ব মানুষে পরিণত হন তিনি।
যুক্তরাজ্যের হোম অফিসের আদেশে ওই ব্যক্তিকে একজন ইসলামপন্থী চরমপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি পূর্বে সন্ত্রাস সম্পর্কিত কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের জন্য বিদেশে ভ্রমণ করতে চেয়েছিলেন এবং তিনি যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ।
ব্রিটিশ সরকার যদিও নাগরিকত্ব পুনর্বহাল করেছে, তবে তার আইনজীবীরা বলছেন যে, কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তাদের আগের দাবির সমর্থনে কোনও ব্যাখ্যা বা সুনির্দিষ্ট কোনও বিবৃতি তারা পাননি। ই৩-এর বিরুদ্ধে কখনও যুক্তরাজ্য বা অন্য কোথাও কোনও ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ আনা হয়নি।
ই৩ বলেন, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগটি এতোটাই অস্পষ্ট যে, এটি এমনকি ইঙ্গিত করে যে আমি সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট নয় এমন কর্মকান্ডে অংশ নিতে কিছু অজানা গন্তব্যে ভ্রমণের চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, আপনি কিভাবে দুনিয়াতে এমন অভিযোগের বিরুদ্ধে নিজেকে রক্ষা করবেন, বিশেষ করে যখন সরকার গোপন প্রমাণের উপর নির্ভর করে? আমার আইনজীবীরা যা পেয়েছেন তা প্রায় সম্পূর্ণরূপে সংশোধন করা হয়েছে। তাই সরকার আসলে কী উল্লেখ করেছিল সে ব্যাপারে আমার কোনও ধারণা নেই।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, আমাকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো না কেন? আমার বিরুদ্ধে এক টুকরো প্রমাণ না দেখিয়ে কেন আমাকে এভাবে শাস্তি দেওয়া হলো? সরকারের উচিত এটি স্বীকার করা যে, তারা ভুল করেছে এবং এটা তাদের মানতে হবে।
ই৩-এর ঘটনাটি এমন সময়ে সামনে এসেছে যখন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদরা বিতর্কিত জাতীয়তা ও সীমানা বিলে থাকা বিতর্কিত পরিকল্পনাগুলো বিবেচনা করছেন। এতে কাউকে না জানিয়েই হোম অফিসকে তার নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
বিতর্কের জন্ম দেওয়া ওই পরিকল্পনায় সতর্ক করে বলা হয়েছে, একই অপরাধে জাতিগত সংখ্যালঘুদের চেয়ে শ্বেতাঙ্গ ব্রিটিশদের সঙ্গে আলাদা আচরণ করা যেতে পারে। ই৩ বলেন, রাষ্ট্রহীন হয়ে যাওয়া এবং কেন হঠাৎ করে আমার নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হলো সেটি জানতে না পারার ঘটনা আমার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর অত্যন্ত বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে হতাশাজনক সময় ছিল।
তিনি বলেন, ব্রিটিশ নাগরিকত্ব আমার পরিচয়ের একটি মৌলিক অংশ। কিন্তু এটা সত্যিই মনে হয় যে, একজন সত্যিকারের নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হতে যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণ ও বেড়ে ওঠার চেয়ে আরও বেশি কিছু প্রয়োজন হবে। একটি জাতিগত পটভূমি থাকার ফলে আপনি দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে যেতে পারেন। ডানকান লুইস-এ তার আইনজীবী ফাহাদ আনসারি বলেন, কোনও বিচারিক ফাঁক ফোকর ছাড়াই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেআইনি সিদ্ধান্তের কারণে আমার মক্কেল তার জীবনের পাঁচটি বছর হারিয়েছেন।
বাংলাদেশে যখন ই৩ রাষ্ট্রহীন সময় পার করছিলেন ওই সময়ে ২০১৯ সালে তার স্ত্রী আরেকটি সন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু তখন নিজের ব্রিটিশ নাগরিকত্ব না থাকায় শিশুটিকেও যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। এখন পিতার নাগরিকত্ব ফিরলেও কন্যার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে হোম অফিস।
উচ্চ আদালত ই৩ এবং তার কন্যাকে এই সিদ্ধান্তের বিচারিক পর্যালোচনার অনুমতি দিয়েছে। বসন্তে এ বিষয়ে একটি শুনানির আশা করা হচ্ছে। আনসারি বলেন, আমরা তার শিশুকন্যার ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবো। যুক্তরাজ্যে পিতার সঙ্গে থাকার জন্য এটা তার আইনি অধিকার।
উল্লেখ্য, ২০০৬ সাল থেকেই যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে ব্রিটিশ জনগণের স্বার্থে দ্বৈত নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে। ২০১৪ সালে রাষ্ট্রের এই ক্ষমতা বাড়ানো হয়। তখন নিয়ম করা হয়, বিদেশে জন্ম নেওয়া ব্রিটিশ নাগরিকদের ক্ষেত্রে দ্বৈত নাগরিকত্ব নেই, এমন ব্যক্তিদেরও সরকার দেশের স্বার্থে রাষ্ট্রহীন করতে পারবে।