এক্ষুণি যেনো মৃত মানুষটি লোহার ট্রে থেকে উঠে বসবে। কথা বলবে। জানাবে, কেন কি কারণে সুন্দর এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন তিনি। সত্যি সত্যি লাশটি উঠে দাঁড়ালে, কথা বললে কেমন হবে। তখন ডোম হিসেবে এখানে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস পাবে নাকি দৌড়ে পালাতে হবে সেকান্দারকে। এতো সুন্দর মানুষটি কিভাবে আত্মহত্যা করলো। কী ঘটেছিলো। এরকম নানা বিচ্ছিন্ন অদ্ভুত চিন্তা, কল্পনা কাজ করেছে শুরুর দিকে। ভয় তখনই লেগেছিলো যখন লাশকাটা ঘরে পা রাখেন সেকান্দার আলী। নিথর দেহগুলো দেখতেন, ভাবতেন আর ভয় পেতেনস। তবে সে ভয় বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। মর্গে ডোমের কাজ করতেন তারই পরিবারের সদস্যরা। তাদের কারণেই লাশকাটার সাহসের জন্ম হয়েছে শুরু থেকেই।
গতকাল লাশকাটা ঘরে দেখা গেছে সেকান্দারকে। সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট পরে বসেছিলেন একটি কক্ষে। সময়টা দুপুর। নির্জনতা নেমে এসেছে চারপাশে। আশপাশে তেমন কেউ নেই। অদূরে এক নারী ও পুরুষ বসে আছেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গের আশপাশের কয়েক গাছে বসে কা কা করছে কাক। বাইরে থেকেই নাকে ভেসে আসছিলো লাশের গন্ধ। সাদা কাপড়ে ঢাকা কয়েক লাশ পড়ে আছে লোহার ট্রেতে। কিছুক্ষণ পরেই ফরেনসিক চিকিৎসকদের উপস্থিতিতে লাশ কাটবেন ডোমরা। সংগ্রহ করবেন ময়না তদন্তের নমুনা। তিনজন ডোম কাজ করবেন ঢামেক হাসপাতালের মর্গে। তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ সেকান্দার আলী। প্রায় ৪০ বছর যাবত লাশ কাটা ঘরে সহযোগী হিসেবে কাজ করেন তিনি। এ পর্যন্ত লক্ষাধিক লাশের ময়নাতদন্তে সহযোগিতা করেছেন এই ডোম।
দেশের অনেক আলোচিত ঘটনার স্বাক্ষী তিনি। দীর্ঘ সময়ে জঙ্গি, সন্ত্রাসী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিদের লাশ কাটতে হয়েছে তাকে। শুরুটা তারুণ্যের প্রথম দিকে। বাবা-চাচার হাত ধরেই লাশ কাটা ঘরে পা রাখেন সিকান্দার আলী। সেদিন তার নাম ছিল রমেশ চন্দ্র। পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে নাম পরিবর্তন করেন।
সিকান্দার জানান, লাশ কাটা করে প্রথম যেদিন পা রাখেন সেদিন ভয় পেয়েছিলেন তিনি। চাচা তাকে সঙ্গে সঙ্গে রেখেছিলেন। ভয়ে ভয়ে সেদিন লাশ ছুঁয়ে দেখেছিলেন সেকান্দার। চাচা অভয় দেন। ভয় পেলে চলবে না। এটি একটি কাজ। এটিও সেবা। মানুষের সেবা। তারপর থেকে শুরু। প্রতিদিন লাশ ঘরে ছুটে যান সেকান্দার। প্রতিদিন গড়ে সাত-আটটি লাশ যায় ঢামেক’র মর্গে। শুরুতে ভয় কাজ করলেও এখন আর ভয় পান না তিনি।
তবে একসঙ্গে অনেক মানুষের মৃত্যু তাকে অনেক সময় ব্যতিত করে। সিকন্দার বলেন, লাশকাটা ঘরে থাকলে মনে ভিন্নরকম চিন্তা আসে। মানুষের ক্ষণস্থায়ী জীবন। মৃত্যু। এসব চিন্তা থেকেই পরকালের প্রতি বিশ^াস দৃঢ় হয়। তবে মৃত দেহ দেখে তিনি ভয় করেন না বলেই জানান।
লাশ কাটতে ইলেকট্রিক্যাল করাত, এক্সরে মেশিন ও এক্সলাবিন ব্যবহার করেন। লাশ যাতে গন্ধ ছড়াতে না পারে এজন্য ব্যবহার করা হয় লাশ সংরক্ষণের কেমিকেল। তারপরও অনেক সময় লাশ থেকে গন্ধ বের হয়। অনেকের কাছে কেমিকেলের গন্ধও অসহ্য লাগে। সেকান্দার বলেন, তবে স্বজনদের কাছে কোনো গন্ধই গন্ধ থাকে না। মর্গে স্বজনের লাশ রেখে দিন-রাত মর্গের বারান্দায় পরে থাকেন অনেকে। তিনি জানান, পেশাগত কাজে অভ্যস্ত চিকিৎসক ও ডোমদের কাছেও লাশ এবং কেমিকেলের গন্ধ সহনীয়-স্বাভাবিক।
বিশে^র বিভিন্ন দেশে মর্গের সহকারীদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়। রয়েছে সামাজিক মর্যাদা। কিন্তু এখানে তা নেই। উত্তরাধিকারীসূত্রে এই পেশায় এসেছেন যে কারণে পরিবার থেকে কোনো বাধা নেই বলে জানান সেকান্দার আলী। কিন্তু সমাজে এখনো এই পেশাটি সেভাবে সম্মানজনক হয়ে উঠেনি। বরং
নেতিবাচকভাবে দেখা হয় ডোমদের। আত্মীয়তা করতে গিয়ে এরকম নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির শিকার হয়েছেন তিনি।
সেকান্দার বলেন, আমি আমার পেশাকে সম্মান করি। সৎভাবে জীবন-যাপন করছি, এটি শান্তির এবং সম্মানের বলেই মনে করি। ঢামেক’র মর্গে সেকান্দারের আরও দুই ভাই ডোম হিসেবে কাজ করেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন, রামু ও বাবুল। সেকন্দার মনে করেন, সরকারিভাবে মর্গের সহকারীদের আর্থিক সুবিধা বাড়ানো উচিত। স্বল্প বেতনে আজকের উর্ধ্বমূল্যের বাজারে অনেক কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়।