ভালোবেসে সুখের আশায় বিয়ে করেছেন। বিয়ের পরপরই সন্তানও ধারণ করেছেন। কিন্তু এরইমধ্যে উপলব্ধি করলেন, সুখ-শান্তির চেয়ে অশান্তি আর জটিলতার মাঝেই ঢুকে পড়েছেন তিনি। প্রতিনিয়ত পারিবারিক ও সম্পর্কের জটিলতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে। বলছি জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী নাজমুন মুনিরা ন্যানসির কথা। গীতিকার মহসীন মেহেদীর সঙ্গে ঘর বাঁধার সাত মাস পর নিজেই এমন কথা জানিয়েছেন তিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় দীর্ঘ একটি স্ট্যাটাস দিয়ে প্রকাশ করেছেন তার অনুভূতি।
আগে ন্যানসি আরও দুটি বিয়ে করেছিলেন। দুই সংসারে দুটি কন্যার মা হন তিনি। এরপর গত বছরের সেপ্টেম্বরে মহসীন মেহেদীকে বিয়ে করেন গায়িকা। মেহেদীও আবার আগে বিয়ে করেছেন, সন্তান আছে। এদিকে নতুন সংসারে ফের মা হতে যাচ্ছেন ন্যানসি। এসব নিয়ে সন্তান ও পরিবারের মধ্যে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে খোলাখুলি লিখেছেন ন্যানসি। তার স্ট্যাটাসটি পাঠকের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো:
`আমার আর মেহেদীর সংসারজীবনের বয়স সাত মাস। এদিকে আমি অন্তঃসত্ত্বা। আমাদের দুজনের জন্যই নতুন করে অল্পদিনের পরিচয়ে একজন আরেকজনের জীবন সঙ্গিনী হওয়ার সিদ্ধান্তটুকু নেয়া কঠিন ছিল। এরই মধ্যে একটি নতুন প্রাণের জন্ম দেয়া যেন আনন্দের চাইতেও দ্বিগুণ ভীতি। আমার দুই ভাই, ভাবি এবং রোদেলা বাদে দুই পরিবারের কোনো সদস্যদের নতুন অতিথির আগমনের সংবাদে নেই কোনো উচ্ছ্বাস, উল্টো রয়েছে বিদ্রূপ মেশানো হতাশা। সেই সঙ্গে নতুন অতিথির আগমনের সংবাদে অর্থ বা সম্পদ বণ্টনে কে কী পাবে আর কী হারাবে, সেসব নিয়ে রয়েছে চুলচেরা হিসাব!
আমি নিজেও যেন ভাবতে বসলাম, আচমকাই গোলক ধাঁধায় পড়ে গেলাম। মনে হলো স্বস্তি খুঁজতে গিয়ে অশান্তিকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে এলাম। বিয়েটা না করলেই বরং প্রাণে না হলেও জানে বেঁচে থাকতাম।
দুজনই ভালোবেসে যার হাত ধরেছিলাম সেটা যেকোনো কারণেই হোক, শেষ পর্যন্ত টেকাতে পারিনি। জীবন চলায় ব্যর্থতার তকমা কপালে জুটেছে। এখন দুজন দুজনের কাছে ভালোবাসার পাত্র-পাত্রী হওয়ার চাইতেও আস্থার হয়ে ওঠাটাই যেন বড় পরীক্ষা! আর প্রতিদিনকার জীবন-যাপন করার প্রক্রিয়া দুজনের এতটাই ভিন্ন যে, সেটা রপ্ত করাটাও বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার!
খাওয়া, ঘুমানো, আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ করার ভঙ্গি, নিত্যদিনের কথা বলা, মত প্রকাশ, গান শোনা, সিনেমা দেখা, ঘুরতে যাওয়া, কাছে আসা- এর সবই যেন নতুন করে শেখার বিষয়! মনে হলো অল্পদিনেই বেশ হাঁপিয়ে উঠেছি।
পূর্বের সংসারে সন্তান যেহেতু আছে, কাজেই তাদের সঙ্গে যোগাযোগও আছে। সন্তানদের কারণে উভয়ের জীবনেই প্রাক্তনদের উপস্থিতি আছে। সেটা উভয়ের সব সময় মন থেকে সহজভাবে মেনে নেয়াটা কঠিন। এ যেন শেষ হয়েও হলো না শেষ।
তার ওপর হঠাৎ খেয়াল করলাম আমাদের চাইতেও আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নাটকীয় উদ্বেগ অন্য অনেকের যেন উথলে উঠছে। মেহেদীর দুই সন্তান তাদের মায়ের বর্তমান স্বামী অর্থাৎ সৎবাবাকে ঠিকই বহু আগেই হাসিমুখে মেনে নিয়েছে; কিন্ত সৎমা হিসেবে আমায় সহ্যই করতে পারে না। অন্যদিকে আমার ছোট মেয়ে নায়লা মেহেদীকে কোনোভাবেই সম্পর্ক অনুযায়ী সৎবাবার আসনটুকু দিতে নারাজ, কিন্তু স্বচ্ছন্দে তার বাবার জন্য পাত্রী দেখছে এবং তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কথাও বলছে।
ব্যতিক্রম আমার বড় মেয়ে রোদেলা। দিন শেষে সে সবাই যার যার মতো করে সুখে আছে এটাই দেখতে চায়। এ কারণে বেচারিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় যথেষ্ট নোংরা মন্তব্যেরও মুখোমুখি হতে হয়। আমার রোদেলা! সন্তানের চাইতেও বেশি যে আমার জীবনে মায়ের রূপে এসেছে! আজ আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু বলতে রোদেলাই আছে এবং থাকবে জানি।
এই সাত মাসের পথচলায় এত বেশি হোঁচট খেয়েছি, সম্পর্কের বিষাক্ত দিক দেখেছি, সন্তানের অবহেলা পেয়েছি, অসম্মানিত হয়েছি, কাছের মানুষগুলোর কাছ থেকে যোগাযোগ হারিয়েছি, সৎ ছেলেমেয়ের কাছ থেকে নিজের সম্পর্কে বারংবার কটু কথা শুনেছি, শ্বশুরবাড়ির তিরস্কার দেখেছি, নিজের অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করেছি, পিতা-মাতাহীন নিজেকে অসহায় ভেবেছি, দু-মুখো মানুষ দেখেছি, থমকে দাঁড়িয়েছি, অবাক হয়েছি, ঘেন্না করেছি, তীব্র ভয় পেয়েছি, কেঁদেছি, টালমাটাল হয়েছি, অভিযোগে দিশেহারা হয়েছি, এত বছরের সংসারজীবনের মাঝপথে এসে নিজেকে একা আবিষ্কার করেছি, চিৎকার করেছি, গালি দিয়েছি, সুন্দর চেহারার আড়ালে কদর্য রূপ দেখেছি, শিক্ষিত মানুষের বিকৃত রুচি দেখেছি, আধুনিকতার নামে বেলেল্লাপনা দেখেছি, নির্মম সত্যের মুখোমুখি হয়েছি, মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছি, অভিমানে বোবা হয়ে গেছি, বিশ্বাস হারিয়েছি, সোশ্যাল মিডিয়ায় আক্রমণের শিকার হয়েছি, সব ছেড়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছি, নিজের মৃত্যু কামনা করেছি, মানসিক অবসাদে ভুগে ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছি- পূর্বে অনেক চড়াই-উতরাই পার হলেও এতকিছু একবারে, একসঙ্গে আগে কখনও ঝড়ের গতিতে জীবনে আসেনি।
আমাদের বিয়ে শুরু থেকেই রসালো আলোচনা, সমালোচনা, গবেষণা, নিন্দা, স্বল্পসংখ্যক শুভেচ্ছা, কাল্পনিক গল্পতে ভরপুর ছিল এবং এখনও আছে; আশা করছি ভবিষ্যতেও বহাল থাকবে।
মেহেদী আর আমার একসঙ্গে ছবি দেখলে মেহেদীর সন্তানরা তাদের বাবার ওপর নাখোশ হয়। মেহেদী কষ্ট পায়, সেই কষ্টের রেশ আমার সংসার ছুঁয়ে যায়। নায়লাকে চাইলেও আগের মতো নিজের কাছে এনে রাখতে পারি না, সত্যি বললে দীর্ঘ ১০ মাস হলো সামনাসামনি দেখিনি। আমারও মন ভার হয়, ফলাফল সংসারে শীতল আবহাওয়া। নিজেদের অজান্তেই প্রতিনিয়ত আমরা স্বামী-স্ত্রী একজন অন্যজনের কাছে অপরাধী!
সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের স্বামীর সঙ্গে ছবি পোস্ট করলে উপহার হিসেবে একগাদা গালি; আতঙ্ক নিয়ে পোস্ট মুছে দিলে পুনরায় সংসার ভাঙার খেতাব! মাঝে মাঝে মনে হয়, বিশ্বজোড়া দজ্জাল শ্বশুরবাড়ি নিয়ে বসে আছি, যাদের কাজ হলো আমার খুঁত ধরা।
উপসংহারে আসি:
এতকিছুর পরও মেহেদী আর আমি সংসার চালিয়ে যেতে চাই, একসঙ্গে বৈরী পথ চলতে চাই, অনাগত সন্তানের মুখ দেখতে চাই, একে অপরকে জীবনে প্রথম প্রেমিক-প্রেমিকা যুগলের মতো ভালোবাসি বলতে চাই, হাতের ওপর হাত রেখে ঘুরে বেড়াতে চাই, দিন শেষে সাত মাসের চেনা ঘরে ফিরতে চাই, সংসারের পরিচিত গন্ধে শ্বাস নিতে চাই, নিজেদের আনন্দের মুহূর্তগুলো সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই, রাত জেগে অহেতুক ঝগড়া শেষে জড়াজড়ি করে ঘুমোতে চাই।
কী অদ্ভুত আমাদের চাওয়া-পাওয়া!!!’